Bullying-এর শিকার

সম্প্রতি একটি সংস্থার সাথে যুক্ত হয়েছি। নাম, The Narrative Bridges। সংস্থাটির মূল উদেশ্য আমাদের নানান সামাজিক পীড়ার বিরুদ্ধে সচেতন করবার। সেটারই কিছু বিষয় নিয়ে ভাবতে ভাবতে bullying-এর প্রসঙ্গ এলো। রোজ রোজ কতজন এর শিকার হয়। 

ভাবছি যে আমি স্কুলে থাকাকালিন যদি এরকম একটি সংস্থার সন্ধান পেতাম তাহলে খুবই উপকার হতো। সে যখন পাইনি আর ভেবে লাভ নেই। জীবনের প্রথম কয়েক বছর বিদেশে থাকার দরুন বাংলা ভাষাটা তেমন রপ্ত করে উঠতে পারিনি। যদিও বাড়িতে মা, বাবা, ঠাকুমা সকলেরই বাংলাতেই কথোপকথন চলতো। বছর সাতেক বয়সে যখন ভারতে ফিরলাম, তখন সামনের এক বছর সকাল বিকেল শুধু বাংলা শিখলাম, পড়লাম, আর লিখলাম। আমাদের এই ছোট শহরে তখন একটিই মাত্র WBSE board-এর English medium স্কুল, অগত্যা সেই স্কুলেই ভর্তি হতে কিছুটা বাধ্য হলাম। কিছু বিছিন্ন ঘটনা বাদে, আমি এই স্কুলে যে আট-টি বছর কাটিয়েছি, বা বলা ভালো কাটাতে বাধ্য হয়েছি, তার অভিগ্যতা খুবই তিক্ত । আমি bullying-এর শিকার ছিলাম। তখন যদিও অনেকেই এটিকে নিতান্তই একটি “fancy word” বলে ভাবতো। 

ছোট কয়েকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করবো, যে ক’টি মনে এতটাই দাগ কেটে দিয়েছিলো যে এত বছর পরও তা স্পষ্ট মনে রেখে দিয়েছি, এবং রাখবো। রাখা দরকার।
 
১। স্কুলের annual sports, তখন আমি ক্লাস টু অথবা থ্রী। বাবা বিদেশে, মা নিজের স্কুল ছুটি নিয়ে সকাল বেলা উঠে আমায়ে Town Club’এর মাঠে নিয়ে গেলো। Televison’এর পর্দায়ে আমার কোন কালেই খেলা দেখতে ভাল লাগতো না, বরং মাঠে নেমে খেলতে তার চেয়ে হাজার গুন বেশি ভাল লাগত। বলা বাহুল্য যে খুবই মেজাজে মাঠে গিয়ে পৌঁছলাম। আমার স্কুলের যিনি Principal তিনি মা’কে ডেকে বেশ কড়া ভাষায়ে বললেন, “মেয়েকে এরম ভেতো বাঙালির মতো সাজিয়ে এনেছেন কেন? এটা কোন স্কুল মনে আছে তো?” প্রসঙ্গত বলে রাখি যে আমার কোমর পর্যন্ত চুল হওয়ায়ে মা আমায় দু’দিকে দু’টো লম্বা বিনুনি করে দিয়েছিল। এও বলে রাখি যে ওনারা চেয়েছিলেন আমি চুলটা কেটে ফেলি, কিন্তু আমি তা করিনি। এইরকম “ভেতো বাঙালি” হয়েই আমি বিদেশের স্কুলেও পড়তে যেতাম। সেখানে আমায়ে কনদিন শুনতে হয়নি “petty Indian” হয়ে এসছি কেনো। যাইহোক। 

২। অঙ্কে আমি বরাবরি কাঁচা। কাঁচা বলাটাও কম বলা হবে যদিও। তবে অঙ্কে কাঁচা এমন মানুষ কিন্তু বেশ কয়েক জনকে পেয়ে যাব হাতের কাছে । তখন আমার বয়েস ১০/১১, অঙ্কের শিক্ষিকাকে প্রচণ্ড ভয় পেতাম, ভয়টা এক সময় এমন একটা অবস্থায়ে গিয়ে দাঁড়ালো যে স্কুল যাওয়ার নামেই ভয়ে কুঁকড়ে উঠতাম। ওই ছোট বয়েসেই বুঝেছিলাম যে বকে, মেড়ে কিছ শেখানো যায়না। Class-এর first boy/girl-এর সঙ্গে দিনের পর দিন তুলনা করে গেলেও আমি algebra’র formulae বা geometry-র theorem বুঝবো না। ওই ছোট বয়সেই বুঝেছিলাম একজনের সঙ্গে আর একজনের তুলনা করা কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে। আমি বুঝেছিলাম, কিন্তু আমার স্কুলের বেশির ভাগ শিখক- শিক্ষিকারাই বঝেননি। অনেক বছর হয়ে গেছে যদিও, হয়তো এতো দিনে বুঝে ফেলেছেন।
Depression ব্যাপারটা ঠিক কি, খায় না মাথায় দেয়, তখন আমার ধারনার বাইরে। তবে এখন ভাবলে ভালই বুঝি যে তখন হয়ত depression’এর মধ্যে দিয়েই যেতাম কিছু কিছু সময়। স্কুলের নামেই ভয়। তখন দু’টো মারাত্যক শব্দ শিখেছিলাম- ‘partiality’ এবং ‘discrimination’। মানে বুঝতেও সমস্যা হয়নি। স্কুল ছেড়ে দিতে প্রায়েই মন করতো। আর যাই হোক, প্রতিদিন বাড়ি ফিরে গুমরে কান্নাকাটি করবার চেয়ে ঢের ভাল। বাড়িতে তো কেউ ক্রমাগত চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে না আমি “worthless”। 

৩। আমাকে আমার মাধ্যামিকের admit card হাতে দেওয়া হয়নি। ডাকা হল মা-বাবা’কে, এটা বলবার জন্য  যে আমার দ্বারা মাধ্যামিক পাস করা দুরের কথা, তাই সেই বছরটা drop দেওয়াই ভাল। কিন্তু কোন ক্রমে পাস যদি করিও, এর বেশি আর এগোনো সম্ভব না। কোনো মতে মাধ্যমিক পাশ হলে থাকতে হবে। আমার মা-বাবার জেদেই পরীক্ষায়ে বসলাম। 

আমার batch’এ একমাত্র second division পেয়েছিলাম আমি। আট নম্বরের জন্য first divison- টা হয়েনি। একটু চেষ্টা করলে আট নম্বরটা পেতাম হয়ত। কিন্তু second division এই খুশি হয়েছিলাম প্রবল। বাড়ির সকলেও। অবশেষে এই স্কুলটা তো ছাড়তে পারব! স্কুলও আমায়ে রাখতে চায়েনি। The feeling was mutual of course! Humanities নিয়ে একটি নাম করা বাংলা medium স্কুলে সুযোগ পেলাম। না, Science পেলাম না বলে না, সবসময়ই চেয়েছিলাম সাহিত্য নিয়েই পড়বো, তাই। দু-বছর বাদে class-এর পাঁচ জনের মধ্যে স্থানাধিকার করলাম উচ্চ মাধ্যামিকে। এই unpretentious বাংলা medium স্কুলের শিক্ষিকাদের অবদান আমি ভুলবো না। 

ওই না পাওয়া আট নম্বরটা আমার অক্ষমতা নয়, স্কুলের অক্ষমতা। একজন ছাত্রীর ওপর বছরের পর বছর মানসিক চাপের দৃষ্টান্ত। 

************************************************************

ফারাকটা অবশ্যই English medium এবং বাংলা medium-এর মধ্যে নয়, কিন্তু আমার ক্ষেত্রে সেটাই হয়ে দাঁড়ায়ে। ফারাকটা মূলত “হ্যাঁ-তে হ্যাঁ, আর না-তে না” মেলানয়ে। ক্রমাগত তুলনার ফলে একজনের মনের অবস্থা যে কি হয় তা বোঝবার চেষ্টা ওনারা কোনদিনই করেননি।

আমকে দিয়ে কিসসসু হবে না, সেটা তো ওনারা বুঝেই গিয়েছিলেন। শুধু শুধু আমার (বা আমাদের মতো ছাত্র ছাত্রীদের ) পিছনে সময় দিয়ে সময় নষ্ট করবার কোন দরকার আছে নাকি?! এখন মনে হয় প্রতিবাদ করিনি কেন? কিন্তু প্রতিবাদ করবার মনের জোরটাও যেন নিয়ে নিয়েছিল। মা বাবাও নিরুপায় ছিলেন। 

তবে এই ক্ষেত্র, বাজের মধ্যেই একটি ভালো লুকিয়ে ছিল। আমি নিজে খুঁজে নিয়েছিলাম। আমি স্থির করে নিয়েছিলাম ভবিষ্যতে আমি কেমন শিক্ষক হতে চাই বা চাই না। কিছু শেখাতে পারি বা নাই পারি, কোন ছাত্র ছাত্রীকে তার দুর্বলতার কারনে দূরে ঠেলে দেবো না। Bully করবো না, discriminate করবো না, কখনও। নিজেকে কথা দিয়েছিলাম। আজ বেশ কয়েক বছর হলো শিক্ষকতা করছি। নিজের দেওয়া কথাটা রাখার চেষ্ট করছি এবং করবও।

Comments

Popular posts from this blog

'আত্মকথা ' -অনিল চৌধুরী