'আত্মকথা ' -অনিল চৌধুরী
১
ভারত ভাগের পরে ১৯৪৭লের অক্টোবরের আট তারিখ কলকাতা চলে আসি। দাদা প্রয়াত ডাক্তার অশোক চৌধুরী ছেচল্লিশ সালেই কলকাতা সায়েন্স কলেজে এম এস সি ক্লাশে ভর্তি হয়। Great Calcutta Killings -এর সময় মুসলিম জনগণ অধ্যূষিত অঞ্চলে নিরাপদেই ক্লাশ করতেন। আমি এসে সিটি কলেজ ভর্তি হই।
তারপরে ১৯৫০ সালে বাবা, মা ও ছোট দুই ভাই অরূণ ও অজয়কে নিয়ে কলকাতা চলে আসি। স্থানীয় লোকেদের অনুরোধ উপরোধে বাবা আসতে পারেননি।বাবা খুব জনপ্রিয় চিকিৎসক ছিলেন। ১৯৫২ সালে আমার ঠিক পরের ভাই ঢাকা বোর্ড থেকে ম্যাট্রিকূলেশন পাশ করার পর নিজের দের বিঘা জমিতে তৈরি বাড়ি ঘর ছেড়ে কলকাতা চলে আসেন স্থানীয় জনগণের অনুরোধ উপরোধ সত্বেও।
কথা ছিল বাবা আমাদের কলকাতায় পৌঁছে দিয়ে বেরা (বাংলাদেশ) ফিরে যাবেন । উল্লাপারা স্টেশন প্রচণ্ড ভীর। কোনরকমে ট্রেনে উঠি। ঈশ্বরদি স্টেশন সেখান থেকে দারজিলিং মেল ধরে আমাদের শিয়ালদহ যাওয়ার কথা
সেখানে নেমে দেখা গেল মায়ের সেমিজের পকেটে রাখা পোস্ট অফিস থেকে তোলা বাবার সারা জীবনের সঞ্চিত টাকা উধাও হয়ে গেছে! বাবার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পরছে। বাবা ঈশ্বরদি ষ্টেশন থেকেই বেরা ফিরে গেলেন। আর আমরা কলকাতা।
৩
দূঃস্বপ্নের পাঁচ বছর
বস্তাবন্দী বাসনপত্র ও মাকে ইছাগূরে ছোটমাসিমার কাছে রেখে আমি 58/1/5D মানিকতলার রাজা দীনেন্দ স্ট্রীটে্র ভাডা করা একশ স্কোয়ার ফুটের একটা ঘরে চলে এলাম। ভাডা মাসিক পঁয়ত্রিশ টাকা। বসবাসকারী পাঁচ জন-জ্যাঠতূতো দাদা, তার বন্ধু, ভবতোষদা, নীলমণিদা ও আমি। কিছূদিন পরে কলকাতা মেডিকাল কলেজের পডূয়া আমার দাদা ও তারও কিছুদিন পরে আমার ছোট দুই ভাই অরুণ ও অজয়। দাদা অবশ্য ফার্স্ট এম বি পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার পরে কলেজের উল্টো দিকের সিল ম্যানসন মেসে চলে যায়।
৪
পূর্ব পাকিস্তান থেকে সীমিত টাকা পাঠানো যেত। দাদার মেসের ৬০ টাকা দিয়ে আমাদের জন্য সামানই্ অবশিষ্ট থাকতো। দাদা স্কলারশিপ পেত, তাই দাদার তেমন কোন অসূবিধা হত না। পিসিমার একটি মেয়েদের স্কুল ও বোর্ডিং হাউস ছিল দীনেন্দ্র স্ট্রিটেই । সেখানে আমাদের দিদি ও বোন ক্লাস সেভেন থেকেই পোড়তো কারণ আমাদের গ্রামের স্কুলে ক্লাশ সিক্সের পর কোএডূকেশন ছিল না!
৫
বেলেঘাটার হায়দার মন্জিলে ১৯ আগষ্ট ১৯৪৭ সালে হিন্দু -মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের দূস্ক্রিতীরা তাঁর কাছে আস্ত্রসমর্পণের পর গান্ধীজী অনশন ভঙ্গ করেন। আমি অক্টোবরে যখন কলকাতা আসি, তখনও সাম্প্রদায়িকতার আগুন ধিকি ধিকি জ্বলছিল। একদিন দীনেন্দ্র স্ট্রীটে দেখি কুখ্যাত গূন্ডা বগলা ুঝির ঝিরে বৃষ্টির মধ্যে কলাপাতার নিচে একটা দেশী পিস্তল নিয়ে চেঁচিয়ে বলতে বলতে যাচ্ছে একটাকে নিকেশ করে এলাম।
৬
৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারী বিকেলবেলা ট্রন্জিষ্টারে সরাই গান শুনছিলাম। হঠাত গান প্রচার বন্ধ, ঘোষণা নাথূরাম গডসে নামের এক যুবক মহাত্মা গান্ধীকে গুলি করেছে। মহাত্মা গান্ধী "হে রাম" বলে লূটিয়ে পরেছেন । কিছূক্ষণ পরে ঘোষণা মহাত্মা গান্ধী ম্রিত। বাইরে বেড়িয়ে দেখি রাস্তা খাঁ খাঁ, দোকান পাট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নির্জন রাস্তাঘাট।
৭
পিসিমার বোর্ডিং হাউসের বাইরে একটা ঘরে আমাদের খেতে যেতে হতো- রাতে ও দূপূরে। ডাল, তরকারি ও কখনও এক টুকরো মাছ। বোর্ডিং হাউসে যা হয়! সকালে ও বিকালে কোয়ালিটির পাউন্ড রুটি, লিকার চা। কলেজ গেলে দূপূরে খাওয়া হত না। আমার একটা টিউশনি জুটে গেল। কিছুটা সূরাহা হল। ছোটমামা অফিস থেকে ফেরার পরে কথনও কখনও কিছু না কিছু খাবার দিয়ে যেতেন। দিদিও সকালে কিছু পাঠাত।
৮
ঐভাবেই চলছিল আমাদের বেঁচে থাকার যূদ্ধ। ৫০'র মাঝামাঝি পূর্ব পাকিস্তানের নোয়াখালিতে আবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শূরু হয়। পিসিমা বাবা-মাকে নিয়ে আসার জন্য আমাকে বেরা পাঠান। নিয়ে আসার সময় কি সর্বনাশ ঘটেছিল প্রথমেই তার কথা বলেছি।
৯
খিদে পেটে কলেজ যেতাম। একটা দুটো ক্লাশ করেই চলে যেতাম কলেজর ঠিক পিছনে বলাই সিংহ লেনে আমাদের আত্মীয় অসিত মৌলিকের বাড়ি । ওঁর আলমারীতে অনেক বই ছিল। Oppenheimer-র লেখা বই ছিল। প্রথমটা পডে দেখলাম বেশ সময় কেটে যায়। Agatha Christie-র প্রায় সব লেখাই পরে ফেলি। চারটে নাগাদ ডেরা।
১০
যা হবার তাই হলো। ডিসকলেজিয়েট হয়ে গেলাম। স্কুল সংক্রান্ত কাজে প্রায়শই পিসীমাকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হতো। পিসিমার সঙ্গে একদিন তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিষ্ট্রার, সতীশ ঘোষ মহাশয়েব সঙ্গে দেখা করলাম ও বললাম মাত্র দূইশতাংশ কম। পিসিমাকে বললেন দয়া করে অন্যায় অনূরোধ করবেন না। অতএব এখানেই কলেজে পড়াশোনার ইতি।
১১
স্বাধীনতার পর ১৯৫০-এ পূর্ব পাকিস্থনের নোয়াখালিতে দাঙ্গা লাগলে পিসীমা আমাকে বাবা,মা ও নবম শ্রেণীর ছাত্র আমার ভাই অসীমকে কলকাতায় নিয়ে আসতে পাঠান।
যখন স্থানীয়লোকজন জানতে পারলো আমি কি জন্য এসেছি তখনই স্থানীয় মূশ্লিম নেতা ও বাবার অনেক হিন্দু ও মূসলমান রোগী অনুরোধ করতে থাকেন যাতে বাবা তাদের ছেড়ে না চলে যান। নাছোরবান্দা। বাবা ফিরে আসবেন প্রতিশ্রুতি দিলে তারা আশ্বস্ত হয়ে ফিরে যান। কলকাতা আসার সময় বাবার সারাজীবনের সঞ্চিত অর্থ ট্রেণে মায়ের সেমিজের পকেট থেকে চূরি হয়ে যায় তা আগেই লিখেছি। বাবা কলকাতা না এসে ঈশ্বরদি স্টেশন থেকেই অসীমকে নিয়ে বেরা ফিরে যান। অসীম ঢাকা বোর্ড অব সেকেন্ডারী এডূকেশন থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করার পর স্থানীয় জনগণের অনুরোধ সত্বেও কলকাতা চলে আসেন। বলেন এই বয়সে একা থাকা সম্ভব নয়। অশ্রুসিক্ত জনগণ বিদায় জানান। তখন ১৯৫২।
১২
ভোরবেলা শিয়ালদহ ষ্টেশনে নেমে লোকাল ট্রেন ধরে ইছাপুরে ছোট মেশোমশাইয়ের ইষ্টপার্কের কোয়াটারে পৌছাতে প্রায় বারোটা বেজে গেল। ছোটমামা এইরকম ব্যবস্থাই করে রেখেছিলেন। বিশাল দূই ঘরের কোয়াটার। ছোটমেশোমশাই তখন মেটাল অ্যান্ড স্টীল ফ্যাক্ট্রির ফোরম্যান । মাকে ওখানে রেখে দুদিন পরে ছোট দুই ভাই অরুণ ও বাবুয়াকে নিয়ে আমাদের ডেরা 58/1/5 ডি তে এলাম । মোট সদস্য হলো ছয়। জ্যাঠতূতো দাদা,ও তার বন্ধু ভবতোষদা, নীলমণিদা ও আমরা তিন ভাই। দুই ভাইকে গরপাড়ের এথেনিয়াম ইনস্টিটিউশনে ভর্তি করা হলো। অষ্টম ও পঞ্চম শ্রেণীতে।
আমি চাকরির চেষ্টায় নেমে পড়লাম। ছোটমামা চেষ্টা করে বার্মাশেলে একটা ইন্টারভিউয়ের ব্যাবস্থা করে দিলেন। ছোটমামামা বার্মা শেলে কেমিস্টের চাকরি করতেন। বার্মাশেলে ইন্টারভিউতে একটি ভূল বললাম। অলিম্পিকে ফুটবল টিমে লেফ্টআউটে কে খেলবে। নির্বাচিত হয়েছিল এক, আর আমি অন্য একজনের নাম বলেছিলাম। চাকরিটা হলো না। রিগ্রেট লেটার পাঠাল অনেকদিন পরে।
১৩
১৯৫১ সালে স্বাধীন ভারতের প্রথম নির্বাচন হয়। প্রথম প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন আই এ এস সূকূমার সেন। সে সময়ে ভারতে প্রায় পঁচাশি শতাংশ নিরক্ষর। ফলে অধিকাংশ ভোটার সিম্বল দেখে ভোট দিত। দীনেন্দ্র স্ট্রীটের ডেরার কেউই নিরক্ষর ছিল না। ছোট দুই ভাই বাদে সবাই ভোটার ছিলাম, (তখন একুশ বছর হলেই ভোটার লিস্টে নাম উঠতো) ভোটও দিলাম। সূখিয়া স্ট্রীটের উল্টোদিকে ডেফ আ্ন্ড ডাম্ব স্কূলের বূথে। লোকসভা সিটে অধ্যাপক হীরেন মূখোপাধ্যায় ও বিধানসভায় পান্নালাল বসু জয়ী হন।
১৪
এবার ডানলিপিলো থেকে ইনটারভিউ।
সবই সঠিক উত্তর। বললেন "very good!" । ডাক এলো না। পরে শূনলাম কোন হোমারার ক্যান্ডিডেটকে নিয়েছে।
সেপ্টেম্বরে খবর পেলাম Lipton কোম্পানীতে সেলস রিপ্রেজেনটেটিভ নিচ্ছে। সোজা ম্যানেজারের ঘরে। ম্যানেজার ছূটিতে।। এ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার মিঃ বাসূদেবন। বললেন "কি করতে পারি আপনার জন্যে?" আমি বললাম "খবর পেলাম আপনারা রিপ্রজেনটেটিভ নিচ্ছেন তাই।" হেসে ফেললেন। কথাবার্তা সবই ইংরেজিতে হলো। বলেলেন এক সপ্তাহের মধ্যে চিঠি যাবে।
এক সপ্তাহ পার। চিঠি এলো না।
সোজা আবার চিত্তরঞ্জন এ্যাভিনিউ।ম্যানেজার উপস্থিত। ইংরেজ। আমাকে বাসূদেবন চিনতে পারলেন। বললেন ভিজিটার্স রূমে গিয়ে বসো। আধঘন্টা পরে ডাক এলো। হাতে চিঠি দিয়ে বললেন পড়ে দেখো । এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। করমর্দনের জন্য হাত বাডালাম। দূজনই উঠে দাঁডিয়ে করমর্দন করলেন। "Best of Luck" বললেন । সেই যে ঢূকলাম ৬ অক্টোবর ১৯৫২-তে , বেরোলাম দুটো প্রমোশনের পর ৮ আগস্ট ১৯৭৬-এ । ইন্টারভিউ সবই মিলিটারি ফেরত নীলমণিদার দেওয়া সাদা প্যান্ট সার্ট পোরে।
১৫
ইতিমধ্যে দাদা অশোক মেডিক্যাল কলেজে পড়া শেষ করে ইন্টার্নশিপ করছে। শিশু বিভাগে হাউসস্টাফ ভাতা পাচ্ছে। বাবা বাড়ী ভাড়া করতে বললেন।
আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের্র পিছনে নীলমণি মিত্র লেনে একটা দোতলা বাডীর একতলা ভাডা করা হলো। বাবাকে বেরা থেকে,মাকে ইছাপূর থেকে নিয়ে আসা হলো। আমিও অরুণ, বাবূয়াকে নিয়ে এই বাডীতে চলে এলাম। দাদাকে মেডিক্যাল কলেজ সংলগ্ন ইডেন হষ্টেলেই থাকতে হলো।
১৯৫২ সালের মাঝামাঝি। আমার চাকরির শুরুও এই বছরেরই, তাও পাকা নয়। ছমাসের প্রবেশন। তিন মাস পরেই ১ ডিসেম্বরে কনফার্মেশন চিঠি। পুরো বেতন । তখনকার দিনে খুব কম নয়। কারণ ডি এ বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্সের। মূল বেতনের প্রায় তিনগূণ।
১৬
১৯৫৩ সালে হঠাৎ দিদির বিয়ে ঠিক হোল। পিসিমার উদ্যোগে ও মায়ের চেষ্টায়। দিদি তখন উইমেন্স কলজে সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী। চারদিন পরে বিয়ে। আমি ক্যাজূয়াল লিভের অ্যাপ্লিকেশন করলাম। নিয়মানূযায়ী সাতদিন আগে আবেদন করিনি।
আবেদন নাকচ হলো।
শেষরাতে বিয়ে। পরের দিন কাজে গেলাম না। পরের দিন ক্যাজূয়াল লিভের চিঠি অফিসে জমা দিয়ে কাজে বেরোলাম। ফিরে দেখি একটা চিঠি। ব্র্যান্চ ম্যানেজারের। কাজ থেকে ফিরে দেখা করার নির্দেশ।
গেলাম। ইংরেজ তনয়। কিছুদিন আগে ট্রেনিংয়ের সময় আমার সঙ্গে দোকানে দোকানে ঘুরেছে। কাজ শিখতে।
বললেন "নিয়মমাফিক আবেদন করনি কেন?"
বললাম "আবেদন করেছিলাম"। নাকচের চিঠি দেখালাম। বললেন "নিয়মমাফিক দরখাস্ত করনি কেন?" বললাম "হঠাত্ বিয়ে"। প্রশ্ন "তোমার বোন তো জানত।" আমি বললাম "না"। প্রশ্ন "তা হয় নাকি?" বঙ্গতনয় আ্যকেউন্ট্যান্ট মতিলালদাসকে জিজ্ঞেস করলেন "এরকম কি সম্ভব?" উনি ঘাড় নাড়ালেন। অতএব।...
কল্যাণী
|
Comments
Post a Comment